ইউরো/মার্কিন ডলার: যেসব গুজবের ফলে বাজারে গতি এসেছে
- বাজারের আবহাওয়া কেমন হবে তা প্রায়ই নির্ভর করে কিছু গুজবের উপর, এই সবের সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ক থাকে খুব কম। বা একেবারে থাকেই না বলতে গেলে। কিন্তু যারাই এই গুজব ছড়াক না-কেন, তারা এসবের ভিত্তিতে নানা অনুমান করে বেস ভাল টাকাই পকেটে পুরে নিতে পারে। গত সপ্তাহে এরকমই কিছু ঘটতে দেখা গেছে।
নভেম্বর থেকেই ইউরো/মার্কিন ডলারের জুটি সাইডওয়েজ ট্রেন্ডে রয়েছে, যা 1.1220-1.1385 রেঞ্জে ঘোরাফেরা করছে। বাজারে পড়তি দশা চলতে থাকার ফলে উক্ত মুদ্রা-জুটির অবস্থা একই থাকবে বলে বেশির ভাগ বিশ্লেষকরাই মত দিয়েছিলেন সপ্তাহ খানেক আগে। ডলার মজবুত হওয়ার পক্ষে যেসব যুক্তি তুলে ধরা হয়েছিল, সেগুলো হল অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য বাজারে আপৎকালীন ভাবে টাকার জোগান দেওয়ার বিষয়টিকে মার্কিন ফেড শেষ করা দিকে কড়া নজর রাখছে, সুদের হার বাড়ানো হয়েছে, এবং ব্যালেন্স শিটকে স্বাভাবিক করার কাজ শুরু হয়েছে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, ফেড-এর প্রধান জেরোমি পাওয়েল বা মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের কোনও কর্মকর্তাই এমন কোনও ইঙ্গিতই দেননি যে, 2022-এ রেট বাড়ানো হবে চার গুণ। এই পরিমাণ রেট বাড়ানোর কথা কোথা থেকে যে ছড়াল তা এখনও স্পষ্ট নয়, কিন্তু এমন গুজব ছডিয়ে খুব বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ার ফলে বহু বিনিয়োগকারীই এটাকে বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন।
11 জানুয়ারি, মঙ্গলবার মার্কিন কংগ্রেসে জেরোমি পাওয়েল যা বলেছেন, তা তাঁর আগের কথারই পুনরাবৃত্তি মাত্র। তিনি ফের জানিয়েছেন যে, গত চল্লিশ বছরে যে রেকর্ড হারে মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে, তার মোকাবিলা করার জন্য রিফাইনান্সিং রেটকে দরকার পড়লে বছরে অন্তত দুবার করে বাড়ানো হবে। এমনকী তিনবার করেও বাড়ানো হতে পারে। অস্যার্থ, নতুন কোনও কথা তিনি বলেননি। কিন্তু বাজার তো অপেক্ষায় ছিল “চারবার করে” রেট বাড়ানোর কথা শোনা যাবে, সেটা আর শোনা গেল না বলে বাজারে হতাশার ছায়া নেমে এল।
এর ফলে ডিএক্সওয়াই ডলারের সূচক একেবারে তলিয়ে গিয়ে 50 দিনের গড় গতিতে গিয়ে থামল, এবং ইউরো/মার্কিন ডলার জুটি পড়ে যাওয়ার বদলে উঠছিল।
মার্কিন মুদ্রাস্ফীতির তথ্যের ফলে পরদিন অর্থাৎ 12 জানুয়ারি বুধবার ইউরো আরও শক্তিশালী হয়ে যায়, এবং ইউরো/মার্কিন ডলার জুটি মধ্যবর্তী সাইডওয়েজ চ্যানেলের সীমা পার করে ক্রমে উপরের দিকে উঠতে থাকে। মে 2021-এর পর ডলার শক্তিশালী হয়ে ওঠার পর এবং তার পরিণতিতে দেড় মাসের সাইডওয়েজ ট্রেন্ডের জন্য বাজারের সূচক স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য পড়েছে 1.1385 জোনে রেজিস্টেন্স ব্রেকডাউনের ফলে। শুক্রবার, 14 জানুয়ারি সকালে তা 1.1482-এ পৌঁছেছিল, যা কিনা আলোচ্য সপ্তাহের সর্বোচ্চ মাত্রা।
সপ্তাহের শেষে মার্কিন খুচরো বিক্রি ও উপভোক্তা আস্থা সম্পর্কিত যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, তা পূর্বের তথ্যে থাকা হারের চেয়ে অনেকটাই খারাপ। মার্কিন অর্থনীতিতে কোরোনা ভাইরাসের নতুন স্ট্রেন ওমিক্রনের নেতিবাচক প্রভাব যে পড়েছে, তা নিশ্চিত হয়ে গেল। তবে এটা এখনও অনুমান করা যাচ্ছে না ফেড-এর পরবর্তী পদক্ষেপে এর প্রভাব কতখানি পড়বে। কিন্তু বাজারের প্রতিক্রিয়া দেখে বলা যেতে পারে যে, নেতিবাচক পরিসংখ্যান দেখার পর নিয়ন্ত্রকরা আরও দৃঢ় কোনও পদক্ষেপ করবেন বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা। এর ফলে ইউরো/মার্কিন ডলার জুটি 1.1415-এ গিয়ে থেমেছে।
স্বল্প মেয়াদে ডলার অবশ্য আরও একটু পিছু হটবে। কিন্তু ফেড-এর রেট বৃদ্ধির নীতি এবং ইসিবি-র রেট হ্রাস করার নীতির মধ্যে ফারাক থাকার ফলে মার্কিন ডলার এখনও ভরসা পেয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও ফেড প্রধান ফের একবার তাঁর সাম্প্রতিক মন্তব্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন যে, মার্কিন নিয়ামক সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উপর, এবং এই আস্থাও জাহির করেছেন যে, মার্কিন অর্থনীতি রেট বৃদ্ধির মোকাবিলা করে যাবে।
অন্যদিকে, বেশ কয়েক জন বিশেষজ্ঞের মতে, একটি ত্রৈমাসিকে একাধিক বার রেট বৃদ্ধি করা হবে। ঠিক যেমনটা দেখা গিয়েছিল ফেডারেল ফান্ড রেট বাড়ানোর পূর্ববর্তী চক্রে। তবে এটা শুধু একটা মত। যা কিনা আরও এক দফা গুজব ছড়াবে এবং প্রত্যাশা বাড়াবে। বিনিয়োগকারীরা এখন তাকিয়ে আছেন মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের জানুয়ারিতে হতে চলা ফেডারেল ওপেন মার্কেট কমিটি (এফওএমসি)-র বৈঠকের দিকে। 26-27 জানুয়ারিতে ওই বৈঠক হবে। সেখান থেকে কী বাস্তবতা বেরিয়ে আসে, সেদিকেই এখন সবার চোখ।
এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ডি1 অসিলেটরের 75 শতাংশই সবুজ সংকেত দিয়েছেন এবং 25 শতাংশ এই সংকেত দিয়েছেন যে, ইউরো/মার্কিন ডলার বেশি দামে কেনা হবে। বাজারের প্রবণতা নিয়ে যাঁরা ইঙ্গিত দেন, তাঁদের 65 শতাংশ সবুজ সংকেত দিয়েছেন এবং 35 শতাংশ দিয়েছেন লাল সংকেত। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বেশির ভাগই (75 শতাংশ) আগামী সপ্তাহে এই মুদ্রা-জুটির উন্নতির কথাকে অস্বীকার করেননি। কিন্তু ফেব্রুয়ারির পূর্বাভাস দেওয়ার সময়েই এইসব মতামত পুরো 180 ডিগ্রি ঘুরে গেছে। 75 শতাংশ বিশ্লেষকই ডলার শক্তিশালী হওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। রেজিস্টেন্স লক্ষ করা হয়েছে 1.1450, 1.1480, 1.1525, 1.1570 ও 1.1615 লেভেলে। সাপোর্ট লেভেল ও জোনগুলো হল 1.1185-1.1400, 1.1300, 1.1275, 1.1220। এর পরেই হবে 1.1185, যা কিনা গত বছরের নিম্ন হার ছিল, এবং এই হার দেখা গিয়েছিল 24 নভেম্বর তারিখে, এবং জোন হবে 1.1075-1.1100।
অর্থনীতির ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, আসন্ন সপ্তাহে আমাদের নজর থাকবে ইউরোজোনের উপভোক্তা বাজার সংক্রান্ত তথ্যের উপর। যা প্রকাশ করা হবে 17 জানুয়ারি, সোমবার এবং 20 জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার। মুদ্রা নীতি সম্পর্কে ইসিবি-র বিবৃতি এবং মার্কিন শ্রম বাজারের পরিসংখ্যান বৃহস্পতিবার প্রকাশ করা হতে পারে। ইসিবি প্রধান ক্রিস্টিন লাগার্ড বক্তব্য পেশ করবেন 21 জানুয়ারি, শুক্রবারে।
জিবিপি/মার্কিন ডলার: ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ড বনাম ফেড: এগিয়ে থাকার খেলা
- এফআরএস ও ইসিবি-র বৈঠকের পাশাপাশি স্বাভাবিক ভাবেই ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ডের বৈঠকও জানুয়ারিতে বসবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, এই নিয়ামক সংস্থা নিজের সতীর্থদের উলটো পথে হেঁটে ডিসেম্বরেই মূল্যবৃদ্ধির মোকাবিলার পথে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে, এবং বাজারে এর মজবুত ছাপ পড়েছে। ইউকে-তে মুদ্রাস্ফীতির হার 5.1 শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। যা কিনা গত 10 বছরে সর্বোচ্চ। তা দেখে ইউকে-র কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক গত তিন বছরে প্রথম বার 0.1 শতাংশ থেকে 0.25 শতাংশ রেট বাড়িয়েছিল। কোরোনা ভাইরাসের নতুন স্ট্রেনের ফলে মহামারী আরও খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে ঢুকে যাওয়া সত্ত্বেও ওই রেট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এইখানেই ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ডের প্রধান অ্যান্ড্রু বেইলির মতের সঙ্গে জেরোমি পাওয়েলের মত মিলে যায়। দুজনের কাছেই প্রথম কাজটা ছিল অর্থনীতি ও সমাজের উপর পড়তে থাকা মূল্যবৃদ্ধির চাপকে কমানো। কিন্তু প্রথম জনের অবস্থানটা অনেক বেশি শক্তিশালী মনে হলেও 15 বেসিস পয়েন্ট রেট বাড়ানোটা খুব সামান্য ব্যাপার হয়ে গেছে। তবু, প্রথম পদক্ষেপ যখন করা হয়েছে, তখন বাজারের প্রত্যাশা ফেব্রুয়ারিতেও আরও একবার রেট বাড়ানো হবে।
এমন প্রত্যাশার মদত ব্রিটিশ এই মুদ্রা পেতেই থাকবে। এর জন্যই জিবিপি/মার্কিন ডলার জুটি গত এগারো সপ্তাহের মধ্যে সবচেয়ে উপরে গিয়ে 1.3748-এ গিয়ে পৌঁছেছে। কিন্তু, তা 200 দিনের এসএমএ ভাঙতে পারেনি, এবং বাজার খোলা থাকার সপ্তাহের পাঁচ দিনে 14 জানুয়ারি, শুক্রবার ডলার মজবুত হওয়ার পর জিবিপি-র সর্বশেষ অবস্থান ছিল 1.3678-এ।
60 শতাংশ বিশ্লেষকের মতে, আসন্ন দিনগুলোতে জিবিপি/মার্কিন ডলার জুটি 1.3800 মাত্রার উপরে ওঠার আরও একটা প্রয়াস হয়তো পেতে পারে। এমন যে হতে পারে, তার সপক্ষে মত দিয়েছেন ডি1 সংক্রান্ত ট্রেন্ড ইন্ডিকেটরদের 90 শতাংশ এবং 80 শতাংশ অসিলেটররা। বাকি 20 শতাংশের মতে, এই জুটি বেশি দামে কেনা হতে পারে। কিন্তু, সাপ্তাহিক পূর্বাভাসের থেকে সরে এসে মাসিক পূর্বাভাসের দিকে তাকালে বলতেই হয় যে, ইউরো/মার্কিন ডলার জুটির মতোই এই জুটিও হয়তো পড়তির দিকে থাকবে। 55 শতাংশেরই মতে, এই জুটি ক্রমশ পড়তে থাকবে।
সাপোর্ট চিহ্নিত হয়েছে 1.3659, 1.3600, 1.3525, 1.3480, 1.3430, 1.3375-এ। এর পরের মজবুত সাপোর্ট হল 100 পয়েন্ট নীচে। রেজিস্টেন্স লেভেলগুলো হল 1.3700, 1.3750, 1.3835 ও 1.3900।
আগামী সপ্তাহের প্রয়োজন মেটাবে ইউকে-র গুরুত্বপূর্ণ ম্যাক্রো ডেটা। 18 জানুয়ারি, মঙ্গলবার দেশের বেকারত্ব ও গড় মজুরি সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যাবে। তার পর দিন উপভোক্তা মূল্য সূচক জানা যাবে। এর পাশাপাশি, ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার গভর্নর অ্যান্ড্রু বেইলি 19 জানুয়ারি, বুধবার বক্তব্য পেশ করবেন। 19 জানুয়ারি, শুক্রবার ডিসেম্বর 2021-এর খুচরো বিক্রির তথ্য প্রকাশ করা হবে। উপভোক্তাদের ব্যয়ের পরিমাপ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সংকেত পাওয়া যায় এর থেকে। সেই সঙ্গে উপভোক্তাদের আস্থার বিষয়েও জানা যায়। যাকে কিনা ইউকে-র অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতির সূচক বলে ধরা হয়ে থাকে। পূর্বাভাস বলছে, উপভোক্তা ব্যয়ের হার 1.4 শতাংশ থেকে কমে মাইনাস 0.6 শতাংশ হতে পারে।
মার্কিন ডলার/জেপিওয়াই: ইয়েন মজবুত হওয়া মানেই ডলার দুর্বল
- জেরোমি পাওয়েলের বক্তব্য এবং মার্কিন ট্রেজারির নিম্ন হার প্রকাশিত হওয়ার পর মার্কিন ডলার/জেপিওয়াই জুটি গত সপ্তাহে 116.35 উচ্চতা থেকে (জানুয়ারি 2017 থেকে এই উচ্চতা বজায় ছিল) 113.47-এ গিয়ে নেমেছিল। কিন্তু ইয়েনকে শক্তিশালী করার জন্য জাপানি নিয়ামক সংস্থা রেট হ্রাস করার নীতির পথে পা বাড়াবে বলে মনে হয় না। ডলার ফের মজবুত হচ্ছে, এবং এই জুটি সারা সপ্তাহের বাজারের শেষে ফের উপরের দিকে উঠে 114.18-তে গিয়ে পৌঁছবে বলে মনে হচ্ছে।
গত দেড় সপ্তাহ ধরে ইউএসডি/জেপিওয়াই পড়তির দিকে আছে বলে ডি1 সংক্রান্ত বেশির ভাগ ইন্ডিকেটরই লাল সংকেত দিচ্ছেন। অসিলেটরদের 80 শতাংশেরও একই মত। তাঁদের 10 শতাংশের মতে এই জুটি বেশি দামে বিক্রি হবে, এবং বাকি 10 শতাংশ সবুজ সংকেত দিচ্ছেন। ট্রেন্ড ইন্ডিকেটরদের মধ্যে 60 শতাংশের পরামর্শ বিক্রি করাই ভাল, কিন্তু 40 শতাংশের মতে কেনাই ভাল। 50 শতাংশ বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, এই জুটি উঠতির দিকে থাকবে, 40 শতাংশের মতে, এটা পড়তির দিকে থাকবে, 10 শতাংশ আবার নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে বসে আছেন।
সাপোর্ট লেভেলগুলো হল 113.50, 113.20, 112.55 ও 112.70। নিকটতম রেজিস্টেন্স জোন হল 114.40-114.65, এবং 115.00, 115.45, 116.00 ও 116.35 লেভেলও আছে।
প্রধান সুদের হার সম্পর্কে ব্যাঙ্ক অব জাপানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হবে 18 জানুয়ারি, মঙ্গলবারে। যা কিনা আগের মতোই ঋণাত্মক মাত্রায়, অর্থাৎ মাইনাস 0.1 শতাংশ থাকবে বলে ব্যাপক ভাবে মনে করা হচ্ছে। আমরা আগেই লিখেছি যে, এই নিয়ামক সংস্থা মনে করে, দেশের কোনও মজবুত মুদ্রার প্রয়োজন নেই, ইয়েন দুর্বল থাকলে পরেই দেশের অর্থনীতিকে তা হয়তো সাহায্যই করবে। কেননা ইয়েন দুর্বল থাকলে তা রফতানির সহায়ক হয় এবং কর্পোরেট ক্ষেত্রে লাভবান হওয়া যায়।
ক্রিপ্টোকারেন্সি: এই ক্ষেত্রেও জেরোমি পাওয়েলকেই ধন্যবাদ দিতে হয়
- 2009 সালের জানুয়ারি মাসে 50 বিটিসি নিয়ে জেনেসিস ব্লক মাইন করে বিটকয়েন মাইননেট-এর সূচনা করেছিলেন সাতোশি নাকামোতো। তার পর মাত্র 13 বছর কেটেছে, এর মধ্যেই চিনের ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিফর্ম কমিশন ঘোষণা করেছে যে, 2022-এর জানুয়ারিতে ক্রিপ্টো মাইনিঙের ‘প্রচলন বন্ধ’ করা হল। অর্থনৈতিক পরিকল্পনার শীর্ষ এক পরিকল্পনা সংস্থার সরকারি বিবৃতির পরেই এই ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই সংস্থার মতে, অধিক স্বচ্ছ ও স্বল্প রিসোর্স ইনটেনসিভ শিল্পকে বেশি করে প্রাধান্য দিতে হবে, এবং মাইনিংকে “অপ্রচলিত” প্রযুক্তিগুলোর তালিকায় রেখে একে বিনিয়োগের জগতে নিষিদ্ধ করে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দিতে হবে।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ঠিকই বলেছিলেন, এই চাঁদের নীচে কোনও কিছুই চিরকাল থাকে না। চিনে ডিজিটাল কারেন্সিগুলোকে “বর্জনীয়” বলে ঘোষণা করার পর ক্রিপ্টো বাজারের ভর কেন্দ্র পুরোপুরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে সরে গেছে। এর আরও একটা প্রমাণ হল এই যে, গত সপ্তাহেই ফেড-এর চেয়ারম্যান জেরোমি পাওয়েল এমন কিছু কথা বলেছেন, তার থেকেই স্পষ্ট যে বিটকয়েনের পতন রোধ করা যাবে এবং ক্রিপ্টোর বাজার ঊর্ধ্বমুখী হবে।
মার্কিন সেনেট ব্যাঙ্কিং কমিটিতে বক্তব্য পেশ করার সময় পাওয়েল বলেছেন যে, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সরকারি ডিজিটাল কারেন্সি সিবিডিসি-র (অর্থাৎ, সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ডিজিটাল কারেন্সি। এটা হল ডিজিটাল ফর্মে থাকা ফিয়াট মানি। এগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে জারি ও প্রদান করা হয়) সঙ্গে স্টেবলকয়েনগুলোকে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু শুধু এতেই ক্রিপ্টোর বাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়নি, এর অন্য কারণগুলো হল ডলার ক্রমশ দুর্বল হতে থাকা এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকা।
এই প্রতিবেদনে ইতিমধ্যে জেরোমি পাওয়েলের একটা কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি স্পষ্টই জানিয়েছেন যে, ব্যালেন্স শিটকে প্রায় 9 ট্রিলিয়ন ডলার হ্রাস করার সিদ্ধান্ত ফেডারেল রিজার্ভ এখনও নেয়নি, এবং 2022-এ চারবার রেট বৃদ্ধি করা হবে না, সর্বোচ্চ তিনবার করা যেতে পারে। এর ফলে, ডিএক্সওয়াই ডলার সূচক নীচে নেমে গেছে। অন্যদিকে, শেয়ার সূচক ও ক্রিপ্টোকারেন্সির দর বেড়ে গেছে।
10 জানুয়ারি বিটিসি/মার্কিন ডলার 39,660 ডলারে গিয়ে পড়েছে। 2021-এর সেপ্টেম্বরের পর এই প্রথম এই জুটির দর এত নীচে নামল। কিন্তু, এসঅ্যান্ডপি500, ডাও জোন্স ও ন্যাসড্যাক ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার ফলে 12 জানুয়ারি এই জুটি 44,300 ডলারে গিয়ে উঠেছে, এবং ক্রিপ্টো বাজারের মোট মূলধনীকরণ ফের একবার 2 ট্রিলিয়ন ডলারের উপরে গিয়ে পৌঁছেছে। যা কিনা মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ বটে। এই হার পৌঁছেছে 2.091 ট্রিলিয়ন ডলারে। কিন্তু ক্রিপ্টো ফিয়ার অ্যান্ড গ্রিড ইন্ডেক্স 15 থেকে 21 পয়েন্ট পর্যন্ত পৌঁছলেও এক্সট্রিম ফিয়ার জোন থেকে বেরোতে পারেনি।
একটা কথা স্পষ্ট যে, ক্রিপ্টো বাজারে নতুন জোয়ার শুরু হওয়ার কথা এখনই বলা যাবে না। বিটিসি/ইউএসটি সর্বকালের সেরা যে-উচ্চতায় এক সময় পৌঁছেছিল, সেখান থেকে এই জুটি এখনও 35 শতাংশ নীচে আছে। অন্যদিকে, এর মোট মূলধনীকরণও এখনও প্রায় 3 ট্রিলিয়ন ডলার থেকে অনেকটাই দূরে আছে। 10 নভেম্বর, 2021-এ ক্রিপ্টো বাজার এই মাত্রায় পৌঁছেছিল। ডলার যদি ফের শক্তিশালী হতে থাকে, তাহলে ডিজিটাল সম্পত্তি ফের পতনমুখী হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ কথা ঠিকই যে, ক্রিপ্টো নিয়ে অতি উৎসাহীরা নিজেদের স্বাভাবিক প্রবণতা অনুযায়ী এই অনুমান করছেন যে, শীর্ষে থাকা কয়েনগুলো শীঘ্রই নতুন উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছবে। ফরচুন পত্রিকায় বাইনান্স ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ-এর সিইও চাংপেং ঝাও একটি নিবন্ধ লিখেছেন। সেখানে তাঁর দাবি, সারা বিশ্বে এই মুহূর্তে ক্রিপ্টোকারেন্সিকে গ্রহণ করেছেন 5 শতাংশ মানুষ, 2022 সালেই এটা এক লাফে 20 শতাংশে গিয়ে পৌঁছবে। কিন্তু গ্যালাক্সি ডিজিটাল-এর প্রতিষ্ঠাতা মাইক নোভোগ্রাৎজ-এর মতে, এখানে 35 শতাংশ পতন লক্ষ করা যাবে, যা কিনা এক “সুস্থ প্রত্যাবর্তন”। তাঁর মতে, প্রধান ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রায় 38,000-40,000 ডলারের সহায়তা পাবে, তার পর এটা বৃদ্ধির পথে ফিরবে। কনসাল্টিং কোম্পানি ডিভিয়ার গ্রুপের সিইও নাইজেল গ্রিনেরও মন্তব্য, বর্তমান সময়ের আবর্তই বিটকয়েন কেনার সবচেয়ে ভাল সময়।
কিন্তু, কোনও-কোনও বিশেষজ্ঞের মতে, এইসব আবেগ খুব বেশি মাত্রায় আশাবাদী। তাই এনক্রাই ফাউন্ডেশনের অনুমান, বিটকয়েনের দাম কমে 28,000-30,000 ডলার হলে পরেই তা বৃদ্ধির পথে ফিরে আসবে। এই কোম্পানির বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্পত্তি পুনরায় ক্রয় কর্মসূচি সম্পূর্ণ হওয়ার পর 2022-এর দ্বিতীয়ার্ধে বাজারে নগদের জোগান কমে যাবে। তখন বিটকয়েন 30,000 ডলারে গিয়ে পড়তে পারে।“
বর্তমান মাত্রাকে বাজারের একেবারে নীচের মাত্রা বলা যেতে পারে না। একই সংকেত দিয়েছেন আরও একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি 8848 ইনভেস্ট-এর প্রথম সারির বিশ্লেষক ভিক্টর পার্শিকভ। তাঁর মতে, এখনও যেসব অবস্থা লক্ষ করা যায়নি, তেমন কোনও অবস্থা দেখা দিলে পরেই একেবারে নীচু মাত্রা দেখতে পাওয়া যাবে। এখন এটা দীর্ঘ সময় ধরে পুরো সমান হয়ে আছে (বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তত দু মাস ধরে), দীর্ঘ কাল ধরে এই অবস্থা বজায় থাকায় এবং মুক্ত সুদ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বাজারে কেনাবেচা করা লোকেদের মধ্যে বিটিসি বিক্রির হার কমেছে। সেই সঙ্গে এটাও স্পষ্টত জানা গেছে যে, সারা বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলো মুদ্রা নীতিকে আরও দ্রুত গতিতে এবং বেশি মাত্রায় শক্ত হাতে ধরে রাখবে।
পার্শিকভ বলেছেন, “ক্রিপ্টো বাজারে বর্তমানে যে-অবস্থা চলছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, সবাই লোকসান হওয়া সত্ত্বেও আবেগের বশে বিপুল মাত্রায় সব বেচে দিচ্ছে। বাজার থেকে খুচরো লেনদেন করা লোকেরা বেরিয়ে গেলেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যাঁদের কাছে বিপুল পরিমাণে বিটিসি আছে, তাঁদের জন্য এই পরিস্থিতি কোনও আশঙ্কার সৃষ্টি করবে না। অধিক বৃদ্ধির পথে এগোনোর আগে বাজারে স্বভাবতই এই ভাবে পণ্যের দরে পরিবর্তন আসে।” তাঁর মতে, বছরের বেশির ভাগ সময় বিটিসির দর 30,000-70,000 ডলারের মধ্যেই ঘোরাফেরা করবে।
এটা স্পষ্ট যে, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিটিসির প্রতি আগ্রহ বাড়লেই বিটিসি-র দর লক্ষণীয় ভাবে বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে এখন সমস্যা আছে বলে মনে হয়। ব্লুমবার্গের মতে, জেপিমর্গান সমীক্ষা চালানোর পর দেখেছে, মাত্র 5 শতাংশ গ্রাহক মনে করেন যে, 2022-এর শেষে বিটকয়েনের দর 100,000 ডলারে গিয়ে পৌঁছবে। 40 শতাংশেরও বেশি গ্রাহকের মতে, বিটকয়েনের দর 60,000 ডলারের মাত্রায় গিয়ে পৌঁছবে মাত্র। ব্যাঙ্ক স্ট্র্যাটেজিস্ট নিকোলাস পানিগির্ৎজোগলোউ-এর মতে, ক্রিপ্টোকারেন্সির ন্যায্য মূল্য 35,000 থেকে 73,000 ডলারের মধ্যে ঘোরাফেরা করবে।
বিটকয়েনের প্রধান প্রতিযোগী হল ইথেরিয়াম। এর সম্পর্কে ক্রিপ্টো বিশ্লেষক জাস্টিন বেনেট মনে করেন যে, গোটা বাজারে যে ভাবে পতন অব্যাহত আছে, সেই দিকে লক্ষ রেখে বলতে হয় “ইটিএইচ-এর দর 4,000 ডলারের নীচে থাকলেই, সবাইকে সাবধানে থাকতে হবে”। আসন্ন সপ্তাহ ও মাসগুলোতে ইটিএইচ যদি এই মাত্রায় ফিরে আসে, তাহলে সেখানে নিজের অবস্থানকে মজবুত করতে পারবে। তবেই আমরা বলতে পারব যে, 2021-এ যে-ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছিল, তা অব্যাহত থাকবে।
বিটিসি-র সামনে ইটিএইচ কেমন থাকবে তা নিয়ে পর্যালোচনা করে বিশ্লেষকদের মনে হয়েছে, ইটিএইচ/বিটিসি জুটির ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদে 1 ইটিএইচ বরাবর বিটিসি হবে 0.18 (7.388 ডলার)। কিন্তু এর জন্য বিটিসি-র প্রয়োজন হবে 0.075 বিটিসি (3.077 ডলার) মাত্রার সহায়তা।
উক্ত আলোচনায় বর্তমান পরিস্থিতিকে অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। তাহলে ভার্চুয়াল কারেন্সিতে আপনি কীভাবে টাকা কামাবেন? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে স্যান ফ্রান্সিসকো (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)-র বাসিন্দা সিরাজ রাওয়ালের কলামে। যেখানে তিনি রসিকতার ছলে ক্রিপ্টো সংক্রান্ত নানা টোটকা দিয়ে থাকেন। তিনি ইথেরিয়াম মাইনিং করার জন্য নিজের টেসলা মডেল 3 গাড়িটি ব্যবহার করেছিলেন। এই গাড়িটি 2018 সালে বাজারে এসেছিল। এর জন্য তিনি অ্যাপল ম্যাক মিনি এম1-এ করেসপন্ডিং ফ্রি সফ্টওয়্যার লঞ্চ করে সেটাকে গাড়িটির সেন্টার কনসোলের সঙ্গে কানেক্ট করেছিলেন। পাঁচটা গ্রাফিক কার্ড চালানো হয়েছিল টেসলা ব্যাটারিতে। রাওয়াল জানিয়েছেন, 2021 সালে এই ভাবে তিনি সারা দিনে 20 ঘণ্টা মাইন করে এক মাসে 400 থেকে $800 ডলার কামিয়েছেন।
ডলারের এই অঙ্ক তো বেশ আকর্ষণীয়ই লাগছে। কিন্তু এর জন্য চাই 50,000 ডলার, যা দিয়ে টেসলার ওই মডেলের একটা গাড়ি কিনতে হবে, এবং এটাও দেখতে হবে যে, মাইন করার এই পদ্ধতিকে চিনা কর্তৃপক্ষরা যেন ক্ষতিকর ও অপ্রচলিত বলে মনে না-করেন।
নর্ড এফএক্স অ্যানালিটিক্যাল গ্রুপ
সতর্কীকরণ: এখানে যা বলা হয়েছে তা বিনিয়োগ সংক্রান্ত পরামর্শ নয় বা আর্থিক বাজারে কাজ-কর্মের কোনও পথ-নির্দেশ নয়। এসব কথার উদ্দেশ্য শুধু তথ্যের যোগান দেওয়া। আর্থিক বাজারে লেনদেন করাটা বেশ ঝুঁকির ব্যাপার এবং এখানে জমা করা পুরো টাকাই জলে চলে যেতে পারে।
ফিরে যান ফিরে যান